মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মাদক মামলাই বেশি ২০১৮ সালে খুলনার অপরাধ চিত্র

খুলনা অফিস : পুলিশের অভিনব কৌশল, গোয়েন্দা নজরদারী ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে ২০১৮ সালে। দু’টি নির্বাচন, বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ, মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান ও জড়িতদের তালিকা প্রকাশ ছিল আলোচিত বিষয়। এছাড়াও একাধিক রহস্যজনক মৃত্যু বিচলিত করেছে সকলকে।

২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে খুলনায় মামলার সংখ্যা কমেছে। বিভিন্ন অপরাধে ২০১৭ সালে মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩৭। ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৮৮৮টি। ফলে মামলা কমেছে ১৪৯টি। এর মধ্যে গেল বছর জেলার ৯টি থানায় মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৩২টি আর নগরীর ৮ থানায় মামলা হয়েছে দুই হাজার ৪৫৬টি। নবেম্বর পর্যন্ত জেলার চেয়ে নগরে মামলা বেশি হয়েছে ২৪টি।

বিগত বছরের শুরুতে মাদকের মামলা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। ৩ মে র‌্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর মাদকের সাথে সম্পৃক্ত ও বিক্রেতাদের একটি তালিকা প্রকাশ করে গোয়েন্দা সংস্থা। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে কঠোর অভিযান পরিচালনা করে যৌথভাবে র‌্যাব ও পুলিশ। ক্রসফায়ারে নিহত হয় একাধিক মাদক বিক্রেতা। একাধিক মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ে মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টরা। মাদকসহ গ্রেফতার করা হয় পুলিশের দুই সদস্যকে। এরপর মাদকের বিক্রি ও সেবনে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলেও তা পুলিশের নজরে আসে। আরও অনেক ঘটনা আলোচিত ছিল খুলনায়।

গত ১৫ মে অনুষ্ঠিত হয় খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের তৎপরতা ছিল বেশি। ৭ মে রাতে সাতরাস্তা মোড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ অভিযান চালিয়ে কাচ্চিঘরের মালিক এস এম ওবায়দুর রহমান টিপুকে গ্রেফতার করে। ৫ এপ্রিল অস্ত্র ও গুলি বিক্রিকালে মিরাজ মোল্লা ও মাসুম হাওলাদার নামে দুই অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৬। তাদের কাছ থেকে ১টি নাইন এমএম পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি ও ১টি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়। বটিয়াঘাটার ঝালবাড়ি এলাকায় ৩১ মার্চ ভাইয়ের হাতে খুন হন ভাই। গোলাম রহমানের ছেলে ছালাম শেখ তার ভাই রুবেল শেখকে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে কুপিয়ে হত্যা করে। ২৮ মে ইয়াবা অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেফতার করা হয় রোহান পরিবহণের মালিকের ছেলে রাসেলকে। ৩০ মে র‌্যাব-৬ এর নতুন উইং কমান্ডার হিসেবে যোগদান করেন ইমন আল রাজিব। ১১ জুন নগরীর শঙ্খ সিনেমা হলের কাছ থেকে ৮০৩ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগজিনসহ সোহেল রানা (২৯) নামে এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২১ জুন খালিশপুর কাশিপুর এলাকার গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয় আইচগাতী এলাকা থেকে। এ ঘটনায় বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ২৫ জুন রাতে নগরীর আবাসিক হোটেল ডিলাক্সের একটি রুম থেকে নড়াইল কালিয়া এলাকার এনসান মোল্লার (২৬) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন সদর থানা পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় দুই মাদক বিক্রেতা মানিক শেখ ও রাজু আহমেদ। ২৪ জুলাই মহেশ্বরপাশা এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ইমরান ওরফে রকি নামে আরেক মাদক বিক্রেতা। ২৭ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা। ৩ আগস্ট ঢাকায় বাস দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ছাত্রদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে নগরী। ১১ আগস্ট আইজার মোড় থেকে ১ হাজার পিস ইয়াবাসহ এপিবিএন-এ কর্মরত এসআই আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সিআইডির কনস্টেবল সোহানুর রহমান ও সোনালী জুট মিল কর্মকর্তা মেহবুব বিন আফতাবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৫ সেপ্টেম্বর রূপসা ঘাট এলাকায় সুমন নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিখোঁজের ১৫ দিন পর তাসকিন হোসেন নামে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর। ১৮ সেপ্টেম্বর গ্যাস সিলিন্ডারে করে পাচারের সময় ১১৫ বোতল ফেনসিলি উদ্ধার করে পুলিশ। ২০ সেপ্টেম্বর মুছা শিকদার নামে রূপসার আঠারোবাঁকী নদী থেকে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন খুবি শিক্ষার্থী সৈকত রঞ্জন মন্ডল। ৩ অক্টোবর মিথুন মন্ডল নামে এক যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার মা প্রমিতা মন্ডলের দাবি তাকে সম্পত্তির লোভে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। বটিয়াঘাটা গুপ্তমারী এলাকার বালু মাঠ থেকে মস্তকবিহীন আব্দুল মোক্তাদীর নামে ঘের ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৩ অক্টোবর রূপসা বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে ১টি পিস্তল ও ১টি রিভলবারসহ ২২নং ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা মো. সাঈদ হোসেন, বাবু বিশ্বাস ও আরিফ মৃধাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ১৫ অক্টোবর খালিশপুরে চারটি পাইপগানসহ সাকিল ও তপন ব্যাপারী নামে দুই অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। একই দিন নগরীর কাগজীবাড়ি এলাকা থেকে বিদেশি পিস্তলসহ রনি মোল্লাকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়। রূপসা সাচিয়াদহ এলাকায় ২৭ অক্টোবর মাদকের অভিযানে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতের শিকার হন জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘খ’ সার্কেলের পরিদর্শক সাইদুর রহমান রানা। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয় ২ নবেম্বর। এদিন ৩২টি বাহিনীর ৩২৮ জন বনদস্যু আত্মসমর্পণ করেন। ১৯ নবেম্বর সিটি কলেজর শিক্ষিকা আত্মহত্যা করেন। ৩০ নবেম্বর গুলিবিদ্ধ হন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দের জামাতা। ২৪ ডিসেম্বর খুলনা জেল প্রশাসক হেলাল হোসেনকে হত্যার হুমকি দেন দুর্বৃত্তরা। কোনো প্রকার সহিংসতা ছাড়াই ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে খুলনার ৬টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ।

খুলনা জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে জেলায় মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৩২টি। এরমধ্যে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা ৬টি, খুন ২১টি, মাদক মামলা ১২৩২টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১৭১টি, চুরি ৫৫টি, অস্ত্র ও বিস্ফোরক ৫০টি, চোরাচালান ৩টি ও অন্যান্য ৮৯৪টি। 

কেএমপি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের নবেম্বর পর্যন্ত কেএমপিতে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা ২টি, খুন ১৬টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ৯৯টি, ধর্ষণ ৩৩টি, ডাকাতি ২টি, মাদক ১৭৫৫টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৭টি, সড়ক দুর্ঘটনা ১৫টি ও অন্যান্য মামলা ৫১৭।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কেএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সরদার রকিবুল ইসলাম বলেন, নগরীর আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তৎপর ছিল পুলিশ। বিশেষ করে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারীতে অনেক অপরাধ ঘটার আগেই তা নির্মূল করা সম্ভব হয়। তিনি আরও বলেন, ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ও নাশকতা সৃষ্টির আগেই অপরাধীদের গ্রেফতার করা ছিল তাদের অন্যতম সফলতা। সেক্ষেত্রে নগরবাসীর সহযোগিতা ছিল প্রশংসনীয় বলে মনে করেন তিনি।

খুলনা জেলা পুলিশ সুপার এস. এম. শফিউল্লাহ্ বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান ছিল বেশি। ফলে এ বছর মাদক মামলা বেশি হয়েছে। অন্যান্য মামলা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। নিয়মিত টহল ও গোয়েন্দা নজরদারী বেশি ছিল। ফলে খুন, ডাকাতি ও নারী নির্যাতন মামলা অনেক কমে গেছে। এজন্য সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছিল বলে তিনি মনে করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ